অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

শনিবার, ১২ জুন, ২০২১

রবি ঠাকুর আমার ঘরে এসেছিলেন

 

 



রবি ঠাকুর আমার ঘরে এসেছিলেন
==========================
রতন চক্রবর্তী
=========================

#এক#

খুট্ করে একটা শব্দ হতেই আমার ঘুমটা চটকে গেলো। প্রথমে চোখ মেলেই সিলিং দেখতে পেলাম। কারণ আমি চিৎ হয়ে শুয়ে আছি। ঘরে নীলাভ একটা ডিম লাইট জ্বলছে। আমি রাতে আলো না জ্বেলে ঘুমাতে পারিনা। ঘাড় কাত করে ডান দিকের দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালাম। রাত দুটো।
কান খাড়া করে রইলাম। বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলোনা। আবার শব্দটা হলো। খুট খাট শব্দ। আমার পড়ার ঘরে কেউ একজন আছে। চেয়ার টানার শ্বদ হলো। মনে হচ্ছে, চেয়ার ঠেলে সরিয়ে কেউ বসা থেকে উঠেছে। তারপর পদশব্দ শুনতে পেলাম। পায়চারি করছে কেউ!


আমাদের বাড়িতে কেউ নেই। মা- বাবা , বাবার এক বন্ধুর ভাইয়ের বিয়েতে গিয়েছে দুই দিনের জন্য। তাই আমি বাড়িতে একা। আমার ভয় ভয় করতে লাগলো। তবু সাহস সঞ্চয় করে বিছানায় উঠে বসলাম। বেড সাইড টেবিল থেকে নিয়ে ঢক ঢক করে এক গ্লাস জল খেলাম। বালিশের কাছে রাখা, "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্বাচিত কবিতা " বইটার দিকে আমার চোখ গেলো। এই বইটায় আমার একটা প্রিয় কবিতা আছে, চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ যেথা শির। /জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর - - -। কবিতাটা সব সময় আমার বুকের মধ্যে বাজে। এখনও তাই বাজছে। কিন্তু আমার চিত্তের ভয় কাটছেনা। বুঝতে পারছিনা, পাশের ঘরে কে! বিপদ জনক কিছু নয়তো?


# দুই #

একবার ইচ্ছে হলো পাশের ঘরে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি। কিন্তু পরক্ষনেই ভয় হলো, যদি ভয়ঙ্কর কিছু চোখে পড়ে। বুকটা ধুক্ পুক্ করছে। একবার, তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি, টিউশান থেকে ফিরছিলাম। রাস্তায়, এক জায়গায় , দুই পাশেই বিশাল বাঁশবন। সেখান দিয়ে ফিরছিলাম। ততক্ষনে সন্ধ্যা উৎরে গেছে। রাস্তা আর বাঁশবনে ঘন অন্ধকার। মনে হলো বাঁশবনের অন্ধকার ভেদ করে কিছু একটা আমাকে ধরতে আসছে। মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো বাঁশ পাতা মাড়িয়ে আসছে ভয়ঙ্কর কিছু একটা। মচ্ মচ্ মচ্ শব্দ হচ্ছে। আমি আতঙ্কে জমে গেলাম। হৃদপিন্ডটা যেন লাফ দিয়ে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসবে। মাথার চুলগুলো চড় চড় করে দাঁড়িয়ে গেলো। দেখলাম বনের ভেতর থেকে একটা আগুনের ফুটকি জ্বলতে জ্বলতে আর নিভতে নিভতে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমি আরো ভয় পেয়ে গেলাম তখন, যখন, কে যেনো নাকি সুরে রবি ঠাকুরের একটা কবিতা পড়তে পড়তে এগিয়ে আসছিলো। মনে হলো কোন ভূতের কন্ঠে কবিতাটা শুনছি, " তাঁল গাঁছ এঁক পাঁয়ে দাঁড়িয়ে, সঁব গাঁছ ছাঁড়িয়ে উঁকি মাঁরে আঁকাশে- - -কেঁ উঁকি মাঁরলো রেঁ? " হঠাৎ কবিতা থামিয়ে ভূত বাবাজি মনে হয় আমাকেই বললো। কারন আমিই উঁকি মেরে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, ভূতটা কেমন। আর সাহস হলোনা। দৌড় দেয়ার জন্য তৈরি হলাম। ঠিক তখনই একটা পরিচিত কন্ঠ কানে এলো। ' আরে দাঁড়া, দাঁড়া, যাচ্ছিস কোথায়? 'বলতে বলতে আমাদের পাড়ার নকুল দা বাঁশ বন থেকে বেরিয়ে এলো। তার হাতে বিড়ি। আগুনের ফুটকি রহস্য ভেদ হলো। নকুল দা বাঁশ বনে লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি খাচ্ছিলো। নকুল দা সামনে মাধ্যমিক দেবে। এমনিতে আমি রবি ঠাকুরের অনুরাগি বলে আমাকে সে খেঁপায়। আজও ভূত সেজে তাই করেছে।
আমার ভূতের অভিজ্ঞতা এই পর্যন্তই।


# তিন #

কিন্তু পাশের ঘরে যে শব্দ করছে, আর জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে আর ফেলছে, সে নকুল দা হবার চান্স নেই। নকুল দা বাড়ি থাকেনা। সে এখন যাদবপুরে লেখাপড়া করে। তাহলে পাশের ঘরে কে? আমার থাকার এই পাশাপাশি দুটো রুম ছাড়া বাকি দুটো বেড রুম লক করা। ডাইনিং রুমটা দিয়ে বাইরে থেকে কারো আসার সুযোগ নেই।
পাশের ঘর থেকে এখন আর কোন শব্দ আসছেনা। কিছুক্ষন পর চেয়ারটা কঁকিয়ে উঠলো। মনে হলো কেউ চেয়ারে নড়েচড়ে বসলো।
হঠাৎ ঐ ঘরে কাউকে গান গাইতে শুনে আমার শরীরের রোম-কূপ গুলো দাঁড়িয়ে গেলো। মেরুদন্ড বেয়ে ভয়ের শীতল স্রোত নেমে গেলো।
যে গান গাইছে তার গলাটা তেমন বলিষ্ঠ নয়।কেমন যেনো চিকন আর ভাঙা ভাঙা। আশ্চর্য! গানটা রবীন্দ্র সংগীত। "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে।- - -" একলাই তো আছি। কে আর সাথে থাকবে? কিন্তু একলা থাকতে তো ভয় লাগছে। তাপর হঠাৎ করেই গানটা থেমে গেলো। তারপর আবার চুপচাপ।
রবিন্দ্রনাথ যেনো আমার রক্তে মিশে আছে। আমি যেমন তাঁর গানের পাগল তেমনি কবিতার আর তেমনি তার ছোট গল্পের। আমার প্রায়ই তার ছোট গল্প "ক্ষুধিত পাষান" গল্পের পাগলটার চিৎকার কানে বাজে, "সব ঝুট হ্যায়, তফাৎ যাও।
আমার এখনও চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, সব ঝুট হ্যায় - -। কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছেনা।
একবার আমি মা-বাবার সাথে বই মেলায় গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। বাবা আমাকে একটা স্টল থেকে সবে "রবি ঠাকুরের কিশোর কবিতা সংগ্রহ" বইটা কিনে দিয়েছে, ঠিক তখনই তাঁকে দেখলাম। একটা লোক। অবিকল রবীন্দ্রনাথ ! সেই সাদা চুল, সেই সাদা লম্বা দাড়ি! আমি তাঁর পিছু নিলাম। বাবা তখন বইয়ের দাম মিটিয়ে দিচ্ছিলো,আর মা দাঁড়িয়েছিলো বাবার পাশে।

কিছুক্ষন পিছু নেয়ার পর আমি রবি ঠাকুরকে হারিয়ে ফেললাম। নিজেও হারিয়ে গেলাম। অনেক খোঁজা খুঁজির পর মেলা কমিটির সাহায্য নিয়ে মা-বাবা আমাকে খুঁজে পায়। মা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় চলে গিয়েছিলি তুই।' আমি জবাব দিয়েছিলাম, 'রবি ঠাকুরের পেছন পেছন।'এত দুঃখের মধ্যেও মা আমার কথা শুনে হেসে ফেলেছিলো।


# চার #

না, আর সহ্য করা যাচ্ছেনা। আমার পড়ার ঘরে কে বসে আছে তা আমাকে দেখতেই হবে। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছিনা এখনো। কেবলই মনে হচ্ছে ঘরে উঁকি দিয়ে ভয়ঙ্কর কিছুনা দেখে ফেলি! একবার মনে হলো বাবা কিংবা মাকে মোবাইলে কল দিয়ে সব বলি। আবার ভাবলাম তাতে ওদের আরো চিন্তা বাড়বে আমাকে নিয়ে। না ওদের কিছু জানানো যাবেনা এই রাত প্রায় তিনটের সময়।
আমি বিছানা থেকে নামলাম।সোজা হয়ে দাঁড়লাম। মনে মনে আবৃত্তি করলাম, 'বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা।/বিপদে আমি না করি যেনো ভয়- - - ' না তারপরও মনে জোর পাচ্ছিনা। ঠিক তখনই পড়ার ঘর থেকে সেই আগের কন্ঠের আবৃত্তি ভেসে এলো,
'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী,
আমার সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।'

কে যেন, "সোনার তরী" কাব্য গ্রন্থ থেকে আবৃত্তি করছে। আমার শোবার ঘর থেকে পড়ার ঘরে যাওয়ার দরজাটা খুলতে গিয়ে দেখি ওপাশ থেকে বন্ধ। আমাদের ডাইনিং রুম দিয়েও পড়ার ঘরে ঢোকা যায়। আমি তাই করলাম। পড়ার ঘরের দরজার কাছে গেলাম পা টিপে টিপে আর ভয়ে ভয়ে। দরজার ভেজা কপাট ঠেলে দিতেই দরজাটা হা করে খুলে গেলো। ভেতরে, আমার পড়ার টেবিলে একটা মোমদানি। তাতে তিনটে মোটা মোটা মোম জ্বলছে! আশ্চর্য! আমার ঘরের বৈদ্যুতিক লাইট নেভানো। আর আমার চেয়ারে বসে আছে স্বয়ং রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর! আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। আমার শরীরে শিহরন খেলে গেলো। আমার সারা শরীর কাঁপছে। আমি এসেছি কবিগুরু হয়তো বুঝতে পেরেছেন।লেখা থামিয়ে হাতের কলমটা দোয়াতের কালিতে ডুবিয়ে রেখে, ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকালো। সাদা দাড়ি-গোঁফের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে মুচকি হসলো। তারপর আমাকে হাত ইশারায় ডাকলো!


এত বড় চমকটা আমার ব্রেন নিতে পারেনি আমি জ্ঞান হারিয়ে দরজার কাছেই লুটিয়ে পরলাম।
জ্ঞান ফিরতেই দেখি সকাল হয়ে গেছে। পড়ার টেবিলের কাছের খোলা জানালা দিয়ে রোদ এসে পড়ছে ঘরে। দৌড়ে ঘরে ঢুকলাম। কিন্তু রবি ঠাকুর কোথাও নেই! তাহলে কাল রাতে আমার ঘরে কাকে দেখলাম? ওটা কী তাহলে আমার মস্তিষ্কের পাগলামি ছিল?

পরিশিষ্টঃ

টেবিলে আমার ম্যাথের খাতাটা খোলা ছিলো। তাতে, কালো কালিতে বিখ্যাত প্যাচানো হরফে একটা কবিতার লাইন লিখা,
"মা যদি হও রাজি,
বড় হলে আমি হব, খেয়া ঘাটের মাঝি। "
হাতের লেখাটা কবিগুরু রবি ঠাকুরের!!




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন